তৃণমূল সমস্যা

ছোটোবেলায় আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাদের চাচাতো ভাই বোনের একটা অনেক বড় সংখ্যা ছিল। আমরা সব সময় এক সাথেই খেলাধুলা করতাম। আমাদের বাবা মা, চাচা চাচীদের মধ্যে একটা ভালো সমঝোতা ছিল, তাদের মধ্যে যত ধরণের সমস্যাই থাকতো না কেন তারা কখনোই আমাদেরকে আলাদা করতেন না। দেখা গেলো, উনারা জগড়া করছেন, আর পাশেই আমরা সবাই খেলতেসি।

আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে ৪-৫ জন ছিল আমাদের চাইতে বড়ো। তারা হয়তো আমাদের সাথে বাচ্চা দের খেলা খেলতো না, কিন্তু তারা সব সময় প্রায়ই বনভোজন (আমাদের ভাষায় টুলা পাতি) আয়োজন করতো। সবাই কোন না কোন ভাবেই শামিল থাকতো। আমরা যারা ছোট ছিলাম তাদের দায়িত্ব হচ্ছে রান্না র জন্য খোর, খুটা জোগাড় করা। আমাদের গ্রামের সব ক্ষেত ই আমাদের জন্য উন্মুক্ত ছিল , আমরা যার ক্ষেত থেকে যা খুশিই নিতে পারতাম।

অনেক সময় দেখা যায় পেঁয়াজ, রসুন, কিংবা যেগুলা সচরাচর সব সময় ক্ষেতে পাওয়া যায় না, সেই গুলা আমাদের ঘর থেকে আনার দায়িত্ব ছিল আমার। আম্মা এখনো মাঝে মাঝে বলে যে কেউ যদি বলতো যে টুলা পাতি খেলবো, ঘর থেকে চাল, ডাল নিয়ে আসতে, আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম। আমি সচরাচরই একটু ডানপিটে, তাই আম্মা ও আমাকে কখনো মানা করতো না।

একটু বড়ো হওয়ার পরে পড়াশুনা র জন্য গ্রাম থেকে চলে গেলাম, কিন্তু এখনো যদি গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাই, আমি সবাই কে নিয়ে কোন না কোন কিছু করার চেষ্টা করি।

আমি মানুষ হিসাবে সব সময়েই সমাজ বদ্ধ হয়ে চলার চেষ্টা করি। আমার ইউনিভার্সিটি জীবনেও আমি সব সময় বন্ধুদের নিয়েই চলার চেষ্টা করতাম। আর সন্তান হিসাবে আমি অনেক ভাগ্যবান, আমি যখনই যত টাকা চাইছি, আব্বা কোনো দিন মানা করে নাই। বন্ধুদের নিয়ে খাবো, ১০০ টাকা দেন, আব্বা কখনোই মানা করতো না। এর মধ্যে অনেক বন্ধুই আমরা সরলতার সুযোগ নিতো, টাকার সমস্যা, সেমেস্টার ফী দিতে লেট হচ্ছে, কিছু টাকা দরকার, আমি আব্বা কে সরাসরি বলতাম, সে কখনো মানা করতো না। কিছুদিন আগে আব্বা বলছিলো যে আমি যে পরিণাম খরচ করছি ইউনিভার্সিটি জীবনে, সেই পরিমান টাকা আমার অন্য ভাই, বোন করে নাই।

কর্মজীবনেও আমার একই মানসিকতার কারণে অনেকেই আমার থেকে সুযোগ সুবিধা নিয়েছে, আমি অনেক কে অনেক ভাবেই সাহায্য করেছি, কিন্তু সময়ে কেউ আমাকে মনে রাখে নাই। প্রফেশনাল ক্ষেত্রে আমার গ্রহণ যোগ্যতা ভালোই ছিল, মানুষজন আমাকে অনেক বিশ্বাস র নিভরশীল মনে করে, সেই সুবাদে আমি অনেককেই তাদের ব্যবসায় উন্নয়নে সাহায্য করছি। এখন আমি ৩ বছর হয় জার্মানী আছি, কিন্তু দেশে এখনও অনেক মানুষ আছে যারা আমার ব্যবসা সেবা নিয়ে থাকে। এখনো আমার প্রায় ৮-১২ টা প্রতিষ্ঠান আছে যারা আমি দেশ থেকে বিদেশ চলে আসলেও আমার থেকেই সেই সেবা গুলা নিয়ে থাকে।

যখন জার্মানি আসলাম, সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য যাই বলি না কেন, আমি হয়ে গেলাম বাংলাদেশ কমিউনিটির সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচের মানুষ। আমার ছোটবেলার কথা মনে পরে গেলো, কিভাবে আমরা মাঝে মাঝেই এক সাথে পিকনিক করতাম। বাকি যারা আছে, সবাই অনেক ছোট, মাত্র ব্যাচেলর শেষ করেই বিদেশে আসছে মাস্টার্স করতে। তাই আমি সব সময়েই নিজ উদ্যোগেই বিভিন্ন ছোট আয়োজন করি, সবাই মিলে একসাথে খাই, গল্প করি। দেখা গেলো রান্না বান্না আয়োজন করা সমস্যা, তাই আমিই সব করা শুরু করলাম। ছোটবেলায় সব সময় দেখেছি , আব্বা আম্মা উনারা ২ জন মিলে ৩০-৫০ জনের লোকের জন্য খারাব আয়োজন করতো। তাই বেশি মানুষের জন্য আয়োজন করা আমার “জিনেই / gene ” আছে। আমি অতি সহজেই সেটা আয়ত্ত করে ফেললাম। দেশে থাকলে জীবনেও রান্না করি নাই, বিয়ের পরে মাঝে মাঝে রান্না করছি, কিন্তু জার্মানি এসে অল্পতেই রান্না আয়ত্ত করে ফেললাম, gene এর রান্না করতে পারা টাও বাবা মা থেকে পেয়ে গেলাম।

কিন্তু মাঝে মাঝে সবাই মিলে কিছু করতে গেলেই প্রায়ই সমন্নতায় সমস্যা হয়, যে আমি সবাইকে নিয়ে ভালো সময় কাটানোর জন্য সব করি, মানুষজন সেটাকে আমার দুর্বলতা হিসাবে নেয়া শুরু করে। সবাই মনে করা শুরু করে আমার অনেক টাকা, অনেক সময়, আর আমার কোন কাজেই নাই, তাই আমি সবাই কে রান্না করে খাওয়াই। বিষয়টা বেশ কিছুদিন ধরেই আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছিলো। এই জন্যেই আজকের এই বিশাল ফিরিস্তি লিখলাম। সমস্যা তা আমার নিজের, আমি সবাইকে নিয়ে এক সাথে থাকতে চাই, এক সাথে গল্প করে সময় পার করতে চাই।

যদি মনে করেন, আপনার টাকা অনেক দামী আর আমার টাকা ঘাস পাতা, যদি মনে করেন আপনার সময়ের দাম অনেক, আর আমি সারাদিন ফ্রি বসে মুড়ি ভাজি, যদি মনে করেন আপনার অনেক ব্যস্ততা, আর আমি সারাদিন বসে বসে ডিমে তা দেই, তাহলে আপনাকে একটা কোথায় বলবো, সমস্যা টা আপনার নয়, আমার, আমিই সবাইকে নিয়ে চলতে চাইছি, সেটা একসেপ্ট করা না করা আপনার ব্যাপার , কিন্তু আমি যেখানেই থাকবো আমি আমার সমাজ বানিয়ে নিবো। আসার সময় আম্মা আর আমার বউ একটা কথাই বলছে, তুমি তো অনেক সহজ সরল, সবাই কে নিয়ে চলতে চাও, একটু সাবধানে চলো, যেন মনে কষ্ট না পাও। ওয়েল , আমি আমার সমাজ নিজে বানিয়ে নেবো, সেখানে আপনি থাকবেন কিনা, সেটা সম্পূর্ণই আমার সিদ্ধান্ত।

(Visited 74 times, 1 visits today)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *